🔥 Burn Fat Fast. Discover How! 💪

ফিরে দেখা ১৯৪১ -(৩)... মানুষ আর মানুষ। আকাশবাণীর নিয়মিত প্রচা | Bangladesh

ফিরে দেখা ১৯৪১ -(৩)...

মানুষ আর মানুষ। আকাশবাণীর নিয়মিত প্রচারে সকলে জানতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে ইহলোক ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। দলে দলে লোক ছুটে এসেছেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যেমন, তেমনই অগণিত সাধারণ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণার পর জনতা উত্তাল হয়ে উঠল। একটি বার তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে দর্শন করবেন। দোতলার পাথরের ঘরেই রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ তখনও। দোতলায় ওঠার দুটি দরজার মধ্যে একটি লোহার কোলাপসিবল বড় গেট। অনেক চেষ্টা করেও স্বজনেরা ভিড় ঠেকাতে পারলেন না। লোহার গেট ভেঙে ফেলল দুরন্ত জনতা। এ কি শোকের চিহ্ন? না বিশ্বখ্যাত কবির মৃতদেহ দেখবার হুজুগ? নিরুপায়, ভীত আত্মীয়বন্ধুরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন। অনেকে অবশ্য দূর থেকে জোড়হাতে প্রণাম করে অন্য সিঁড়ি দিয়ে ধীরে নেমে যাচ্ছিলেন।
তখনই দেখা গেল একদল যুবক জলের পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠছে। ভিড়ের মধ্যে তারা মিশে থাকল। গুরুদেবের মৃত্যুর খবর পেয়ে যাঁদের হৃদয় ভেঙে গিয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগ মনমরা হয়ে রইলেন শান্তিনিকেতনে, কলকাতার ভক্তরা লুকিয়ে রাখলেন নিজেকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর যা ঘটতে লাগল, তাতে তাঁদের কোনও অংশ নেই। তবে এত বিশৃংখল জনতা কোথা থেকে এল? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক? যাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত সম্পর্ক ছিল, তাঁদেরই একজন বনমালী, কবির 'লীলমণি', এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন। ভিড় ঠেলে কবির সামনে যেতে পারছেন না। রথীন্দ্রনাথ শোকে ভেঙে পড়েছেন। প্রতিমা দেবীও কাছে পিঠে নেই, তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জনতার গর্জনের মধ্যেই দরজার ছিটকিনি তুলে দেওয়া হল একরকম জোর করেই। গুরুদেবকে স্নান করানো হবে, সাজিয়ে দেওয়া হবে শেষবারের মতো। রানী মহালানবিশ, নন্দিতা (বুড়ি), অমিতা পরম শ্রদ্ধায় রবীন্দ্রনাথকে যত্ন করে সাজাবেন। ছেলেদের মধ্যে ঘরে সুরেনবাবু, বিশু, আরও কয়েক জন পাহারায় আছেন। স্নান করানো হচ্ছে যখন কবিকে, তখনই দরজার ছিটকিনি খুলে পড়ল মানুষের ধাক্কায়। ঢুকে পড়ল হতচ্ছাড়া যুবক বাহিনী। মেয়েরা তাড়াতাড়ি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে ধরে আড়াল করলেন। আর্তনাদ করে উঠলেন রানী। চিত্‍কার করে বললেন, "বাইরে যান সব। কবিকে এ কী অপমান!"
জীবদ্দশায় লাজুক, স্পর্শকাতর মানুষটার মৃতদেহ কাদের কাছে এমন লোভনীয় হয়ে উঠল? তাদের স্বার্থটাই বা কী? পৃথিবীকে দেখানো রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক?
সুরেনবাবুরা সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা ঠেলে রইলেন। দরজা কাঁপছে মানুষের ধাক্কায়। উন্মত্ত চিত্‍কার শোনা যাচ্ছে, "দরজা খুলে দিন... দরজা খুলুন..."
কবিকে দ্রুত পরানো হল বেনারসির জোড়, চন্দনে সাজানো হল কপাল। চাদর পাট করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। অলৌকিক ব্যাপারই যেন, এত যে রোগকষ্ট ভোগ করেছেন কিছু কাল যাবত্‍, এখন মুখে তার কোনও ছাপই নেই। অপরিসীম শান্তি যেন তাঁকে আবার স্নিগ্ধ করেছে।
রানী চেয়ে চেয়ে দেখছেন। মন ভরছে না। কিন্তু তাঁকে কে সময় দেবে? উন্মত্ত জনতার দর্শনের জন্য কবিকে এই ঘরে রেখে তাঁদেরকে এখনই আড়ালে যেতে হবে। হঠাত্‍ তাঁর মনে হল, রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপারেশন হল, কোনও লাভ হল না। কবির বরাবরের কামনা ছিল আরেকটি, তিনি শান্তিনিকেতনে সমাপ্ত হতে চান। রানীকে কত বার বলেছেন কবি, "তুমি যদি আমার সত্যি বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে।"
কবির ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নীচে, আশ্রমের ছেলেমেয়েদের মাঝখানে তাঁর জীবনের সমাপন হবে। যেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না।
রানী একজন কাউকে খুঁজে বেড়ালেন, যাঁকে বলবেন কবিকে নিয়ে যেতে হবে শান্তিনিকেতনে। গুরুত্বপূর্ণ কাউকেই তিনি দেখতে পেলেন না। সব অচেনা মাতব্বরে ভরে গিয়েছে চারপাশ। শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের এক প্রাক্তন ছাত্রকে সবটা বললেন। তিনি ছুটে গেলেন বড়দের কাছে। কিছুক্ষণ পর ম্লানমুখে ফিরে এসে বললেন, "না রানীদি, হল না। সবাই বলছেন শান্তিনিকেতনে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানেই সব আয়োজন হয়ে গিয়েছে।" ভাঙচুর মন নিয়ে রানীর মতো শেষবেলার কর্তব্যনিষ্ঠ সেবাকর্মীরা দূরে দূরে পড়ে থাকলেন। কারা সিদ্ধান্ত নিলেন, কারা লাফিয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথের ওপর, জানা গেল না। জানতে পারলেন না কবির ঘনিষ্ঠরাই। শান্তিনিকেতনের মানুষরা উপেক্ষিত থাকলেন। মাথা নিচু করে তাঁরা যার-যার কর্তব্য করে যেতে লাগলেন আজও।
তিনটে নাগাদ দুপদাপ করে ঘরে ঢুকল বেশ কিছু অচেনা লোক। একপ্রকার জোর করেই দুর্বিনীত ভঙ্গিতে তারা কবির অপরূপ সাজে সজ্জিত শুভ্র নিথর দেহখানি তুলে নিয়ে চলে গেল। যেন কেড়ে নেওয়া হল। ভেঙে পড়লেন কবির অন্তিম পর্বের সহচরীরা। মেয়েদের নীরব অশ্রুই প্রকৃত শোকের মতো ভিজিয়ে দিল শ্রাবণ মাস, বর্ষা ঋতুকে।
বাইরে সেই গর্জনই উঠল, "জয় বিশ্বকবির জয়"। পালঙ্কে শোয়ানো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জোড়াসাঁকোর বাইরে বের হল ওরা। উত্তর কলকাতার বড় বড় রাস্তা ঘুরে মৃতদেহ নিমতলায় যাবে। মানুষের অগুনতি মাথা। কোথাও এতটুকু ফাঁকা দেখা যাচ্ছে না। বাড়িগুলির বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়েছে শয়ে-শয়ে জনগণ। আর-একটু পরেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ দেবতাকে নিয়ে চরম কলঙ্কি